অমৃতের সন্ধানে - প্রথম পর্ব


শোনো বন্ধু শোনো,

প্রাণহীন পুব বাংলার ইতিকথা...

কুঁজোরও মাঝেমধ্যে সাধ হয় চিত হয়ে শুতে। ঠিক তেমনই, পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় বিবেকবান সংস্কৃতিমনস্ক আঁতেল ভদ্দরলোক বাবু, যাঁরা "উফফ! ভাগ্যিস বাংলাদেশ ছিল, তাই বাঙালি সংস্কৃতিটা বেঁচে গেলো" বলে সকাল বিকেল তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে থাকেন, অথচ বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে তাঁদের অনেকেরই পূর্বপুরুষের ভিটেতে কেন তুলসীমঞ্চে সন্ধ্যাপ্রদীপ দেওয়ার মত আর কেউ নেই সেকথা জিজ্ঞাসা করলেই গর্জনশীল চল্লিশা বা ক্রোধোন্মত্ত পঞ্চাশের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গগর্জনের ন্যায় "আহ! ওসব কথা থাক।" বলে ফোঁস করে ওঠেন, এবং এইভাবে খাঁটি নির্ভেজাল সম্প্রীতির চর্চা করার মাধ্যমে পরমগণতান্ত্রিক পরমধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ জ্ঞানের গাজররূপে নিজেদেরকে প্রতিপন্ন করে পরমানন্দে বিভোর হয়ে থাকেন—সেই বংবাবুদেরও মাঝেমধ্যে সাধ হয় দুদিনের জন্য বাঙালিয়ানা দেখাতে। কিন্তু সিলেটের হাওড়ে, বরিশালের নদীনালায় রাধারমণের ভক্তিগীতি, মুকুন্দদাসের চারণগীতির সুরে আজও ধ্বনিত হয়ে চলে এক করুণ আর্তি, "তুমি কেন জিততে পারলেনা রাজেন্দ্রলাল? তোমার সাথে সাথে আমরাও যে হেরে গেলাম!"—সেটা এনাদের কেউ শুনতে পায়না! পাবেই বা কীকরে? জীবনে কোনোদিন রাজেন্দ্রবাবুর নাম শুনেছে?

বাংলা বর্ণমালার প্রত্যেকটা বর্ণ জানে, নোয়াখালীতে রাজেন্দ্রলালের কাটা মুণ্ডু তাঁর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গোলাম সারোয়ারের কাছে ভেট হিসাবে যাওয়া পর্যন্ত তার থেকে যতফোঁটা রক্ত পড়েছে, প্রত্যেকটা রক্তের ফোঁটায় তারা সিক্ত! পূর্ববাংলার পথের ধারে রাতের অন্ধকারে ভারতে-যাওয়া পরিবারগুলোর ফেলে-রাখা সদ্যোজাত শিশুদের কান্নার আওয়াজ আজও অব্যক্ত হয়ে ফুটে ওঠে বাংলা বর্ণমালার প্রত্যেকটা বর্ণ, বাংলা শব্দভাণ্ডারে বাঙ্গালীর প্রতিটি আবেগমাখা শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে। আর কেউ শুনতে না পাক, তাদের হতভাগ্য বাবা-মায়েরা আজও তা শুনতে পান।

যাইহোক, ভারতবর্ষ সাধু-সন্ন্যাসীর দেশ। সংসার ত্যাগ করলেও বাস্তব বোধবুদ্ধি লোপ পায়নি এরকম অনেক সন্ন্যাসী আজও সাধনরত দেবতাত্মা হিমালয়ের নানান কন্দরে কন্দরে। মা ঢাকেশ্বরী-চট্টেশ্বরীর আশীর্বাদধন্য পূর্ববঙ্গ আজ শ্মশানে পরিণত। সেই অভিশপ্ত ভূমি থেকে ভেসে আসা সন্তানহারা মায়ের কান্নার আওয়াজে যেন প্রতি মুহূর্তে ভারী হয়ে ওঠে তাঁদের সাধনক্ষেত্র।

একদিন এক সন্ন্যাসী মনস্থির করে ফেললেন। পাণ্ডববর্জিত সাধনক্ষেত্র ত্যাগ করে দুঃখিনী মায়েদের কোলে কালরাত্রির ভয়াবহ পরিবেশের মধ্যে বসেই তিনি খুঁজবেন আলোর পথে যাত্রা করার দিকনির্দেশ। খুঁজবেন ভারতীয় উপমহাদেশের এক বিষম সমস্যার সমাধানের সূত্র। দেবভূমি ছেড়ে মর্ত্যলোকের ভারতবর্ষের পথে যাত্রা করলেন তিনি। প্রথমে পানিপথের প্রান্তর, সেখান থেকে পদব্রজে সুদূর বঙ্গোপসাগরের কোলে নোয়াখালীর করপাড়ায় রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর ধ্বংসপ্রাপ্ত বাসভবনের দিকে। হ্যাঁ, এই সেই দুই প্রান্তর, যেখানে ভারত-ইতিহাসের গতিধারা নির্ধারিত হয়েছে কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে।

এগিয়ে চলেন সন্ন্যাসীঃ ভারতীয় যোদ্ধাদের নির্ভীক আত্মত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত এই দুই স্থানে নিজের দেহ থেকে রক্ত অঞ্জলি দিয়ে কলিযুগের সেই পরাজিত ধর্মযোদ্ধাদের আশীর্বাদ নিয়েই তিনি বাস্তব জগতে সনাতনী মানুষের ধর্মযুদ্ধের নতুন পথের দিশার সন্ধানে সাধনায় বসবেন।

ভারত পেরিয়ে(?) একটা সময়ে তিনি প্রবেশ করলেন বাংলাস্তানে। বিভিন্ন মন্দিরের চাতালে দিনের বেলায় বিশ্রাম নেন। পথ চলতে থাকেন রাতের অন্ধকারে।

এই সেই সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা প্রান্তর! মুক্তবেণীর গঙ্গা তার স্নেহধারার একটি প্রশস্ত শাখা প্রসারিত করে দুর্নিবার ব্রহ্মপুত্রের সাথে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতে উঠে এখানেই তো গড়ে তুলেছে পৃথিবীর উর্বরতম ভূমি! কোন অভিশাপে আজ এই ভূমিতে দিবানিশি বেজে চলে ধ্বংসের দামামা! সন্ন্যাসীর মন জাগতিক বিষয়ে বিচলিত হয়না ঠিকই, কিন্তু পূর্ববাংলার নদী মাঠ প্রান্তর যে বিষাদের ব্যথায় কেঁদে চলেছে তিনি সেই হৃদয় নিংড়ানো বেদনার আর্তি শুনে নিজেকে সামলে রাখতে পারেননা।

পথ চলতে চলতে আসে খুলনার সেনহাটি গ্রাম। এই গ্রামেই 'জজের ঘাট'-এ বসে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎই নিজেদের মধ্যে বাজি রেখে ভৈরব নদে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে পারাপার করে আসত কত বেপরোয়া তরুণের দল। তাদেরই একজন ছিল অনুজা সেন। ক্রূর চার্লস টেগার্টকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে পুনর্জন্মের সংকল্প নিয়ে ফাঁসির মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছিল সে। জন্মান্তরে কোন ঘাটে সে উঠেছে সাঁতার দিয়ে? ভৈরব নদ যেন চুপিচুপি জানতে চায় সন্ন্যাসীর কাছ থেকে। অশ্রুসজল চোখে গ্রামটির মাটিকে প্রণাম করে বিদায় নেন সন্ন্যাসী।

এগিয়ে চলেন বরিশালের গাভা গ্রামের দিকে। যে গ্রামের ক্ষণজন্মা সন্তান বিপ্লবতাপস হেমচন্দ্র ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশসিংহের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের এই সর্বাধিনায়ক তাঁর নিখুঁত পরিচালন-নৈপুণ্যে দলের সভ্যদের কৃতিত্বে অর্জন করেছিলেন একের পর এক ব্রিটিশ প্রশাসকের রক্তে দেশবাসীর অপমানের প্রতি শোধ নেওয়ার মত দুঃসাধ্য গৌরব। দেশভাগের পর তিনি কলকাতা-নিবাসী হয়ে যান। কিন্তু না, নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার পর সেখান থেকে বাঙালি সংস্কৃতির ঠিকা নিয়ে রাখা কোনো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এসে তাঁকে সসম্মানে নিজের শৈশবের উপবনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে যায়নি। নেতাজি সুভাষের পাদস্পর্শে ধন্য এই গ্রামে আজ পনেরোই আগস্ট-তেইশে জানুয়ারি-ছাব্বিশে জানুয়ারি কোনোদিনই ভারত রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলিত হয়না কোনো গৃহস্থের বাড়িতে।

"শুধু যদি সেদিন রাজেন্দ্রবাবু হেরে না যেতেন!" আপনমনে বলতে বলতে গাভার মাটিকে প্রণাম করে বানারীপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন সন্ন্যাসী।

আয়ারল্যাণ্ডের 'Fianna Fail' পত্রিকায় একদিন বাংলার বিপ্লবীদের এক অমর কীর্তির গাথা সপ্রশংস শ্রদ্ধায় প্রকাশিত হয়েছিল। কী সেই অমর কীর্তি?

ব্রিটিশ প্রশাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা জন অ্যাণ্ডারসন। মেদিনীপুরে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের দুর্দমনীয় বিপ্লবীদের হাতে পরপর তিনবছর তিনজন ব্রিটিশ জেলাশাসক খুন হওয়ার পর বাংলার নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত গভর্ণর হয়ে এসেই তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন, কত শক্তি ধরে বাংলার এই বিপ্লবীরা তা আমি একবার দেখতে চাই। মু.সলিম লীগের কিছু পেটোয়া পা-চাটা ক্যাডারদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলতে লাগলেন ভিলেজ-গার্ড বাহিনী।

বিপ্লবীরা চুপ করে বসে রইলেন না। অ্যাণ্ডারসনকে কড়ায় গণ্ডায় সমস্ত হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা দেখা গেল দার্জিলিংয়ে লেবং এর ঘোড়দৌড়ের মাঠে।

সমবেত দর্শকদের মধ্যে থেকেই সরাসরি বুলেট ছুঁড়ে পরাধীন দেশবাসীর তরফ থেকে অ্যাণ্ডারসন সাহেবকে যথোচিত অভ্যর্থনা জানালেন এই বানারীপাড়ারই বীর সন্তান ভবানী ভট্টাচার্য। সঙ্গে ছিলেন রবি ব্যানার্জী। যদিও শেষপর্যন্ত তাঁরা সফল হননি‌।

তবু, 'Fianna Fail' পত্রিকা সেদিন লিখেছিল, "আমরা যা পারিনি, বাংলার বিপ্লবীরা তা পেরেছেন। অভিনন্দন জানাই তাঁদের।"

আজও বানারীপাড়ার নদী-মাঠ অধীর আগ্রহে ভবানীর পুনর্জন্মের প্রতীক্ষায় দিন গোণে।

(ক্রমশ).......

মন্তব্যসমূহ