অমৃতের সন্ধানে - দ্বিতীয় পর্ব
প্রথম পর্বের পর.....
ফিরে যাওয়া যাক আরো কয়েক দশক আগে। স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেশপ্রেমিক হিন্দু গৃহস্থের দল তখন বন্দে মাতরম্ উচ্চারণের উপহারস্বরূপ ব্রিটিশের পোষা গোর্খা পুলিশের লাঠির বাড়ি খাচ্ছেন বরিশালের ঘরে-ঘরে। এরকমই এক পরিস্থিতিতে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসল বরিশালে। সেখানে দেশপ্রেমিক জনতার মিছিলে বেপরোয়া লাঠি চালালো পুলিশ, মাথা ফেটে রক্তারক্তি অবস্থায় 'বন্দে মাতরম্' ধ্বনির বজ্রনির্ঘোষ শোনা যেতে লাগলো চিত্তরঞ্জন গুহঠাকুরতার কণ্ঠ থেকে। পুলিশের লাঠির যেমন বিরাম নেই, তেমনই বিরাম নেই চিত্তরঞ্জনের বন্দেমাতরম্ ধ্বনির। একটা সময়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পথপার্শ্বের পুকুরের জলে পড়ে গেলেন তিনি। তখনো থামেনি তাঁর 'বন্দেমাতরম্' বলে দৃপ্ত কণ্ঠের স্বর। জল লাল হয়ে ওঠে রক্তে। অবশেষে চিত্তরঞ্জনের জীবন্ত সলিলসমাধি যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে, তখনই এক পুলিশ নিজেই তাঁকে কোনোক্রমে জল থেকে টেনে তোলে।
এই চিত্তরঞ্জনই পরে নেতাজি সুভাষকে দেশগৌরব উপাধি দেন কলকাতা নগরীর এক জনসভায়। বানারীপাড়া গ্রাম ধন্য, এমন এক দেশহিতৈষীর জন্ম দিয়ে।
ভাবতে ভাবতে বানারীপাড়ার লঞ্চঘাটে এসে দুদণ্ড বসেন সন্ন্যাসী। স্বয়ং সুভাষচন্দ্র এই গ্রামে পদার্পণ করেছেন, গ্রামের মেয়েদের হাতের তৈরী নারকেলের প্রসাদ খেয়ে পরম তৃপ্তি লাভ করেছেন। স্বাধীন ভারতে এ গ্রাম তার সগর্ব উপস্থিতি নিয়ে ভারতবাসীর তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারেনি—এ লজ্জা কার?
এক অদ্ভুত অনুভূতির নিঃশব্দ আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকেন সন্ন্যাসী। ইহজাগতিক সুখ-দুঃখের নাগরদোলা যাঁর মনকে স্পর্শ করতে পারতনা, কোন এক অজানা সংকল্পে দৃঢ় হয়ে ওঠে তাঁর চোয়াল।
আবারও পথ চলতে শুরু করেন সন্ন্যাসী। ভারতভূমিতে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার এই আদি পীঠস্থান বরিশালের পুণ্য ঐতিহ্য উন্মত্ত জ্বী.হাদি বর্বরতার অন্ধকারে, খুন-লুণ্ঠন-ধর্ষণের রক্তস্রোতে ডুবে গিয়েছিল '৫০এর ভয়াবহ গণহত্যায়। মহাপ্রাণা লীলা রায়ের 'জয়শ্রী' পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত দাশগুপ্ত সখেদে লিখে গিয়েছিলেন, "মাধবপাশা ও মূলাদী গ্রামে যাহা ঘটিয়াছে তাহার নির্লজ্জ পাশবিকতা বরিশালের মুসলমান সম্প্রদায়কে চিরকালের জন্য কলঙ্কভাগী করিয়া রাখিবে।"...
বাঙ্গালী হিন্দুর সেই বধ্যভূমি মাধবপাশা গ্রাম পেরিয়ে সন্ন্যাসী এগিয়ে চলেন গৌরনদী হয়ে মাদারিপুরের দিকে। পথে পড়ে বাটাজোর গ্রাম। এই গ্রামেরই এক দেশ-অন্ত-প্রাণ যুবক একদা পাঞ্জাব ভ্রমণে গিয়ে গুরু গোবিন্দ সিং, রণজিৎ সিং, দলীপ সিং প্রমুখের কীর্তিকলাপ, অস্ত্রাগার, সমাধিস্থল দর্শন করে আপন সহধর্মিণীকে লিখেছিলেন,
"...একবার মনে হয় গুরুগোবিন্দের ঢালখানি লইয়া পলায়ন করি, মনে হয় ওই পতাকাগুলি, অস্ত্রগুলি কলঙ্কের নিদর্শন স্বরূপ রাভি নদীর জলে বিসর্জন দেই; মনে হয় দলীপের ক্রীড়াসামগ্রী কামানটি বুকে করিয়া উচ্চরোলে কাঁদিতে থাকি— কত কি ভাব হয় কি লিখিব?..."
হ্যাঁ, দেশের জন্য পাগল সেই বরিশাইল্যা যুবক, যাকে সবাই অশ্বিনীকুমার দত্ত নামে জানে, যাঁর হৃদয় সর্বক্ষণ প্রতিবেশী গরীব মুসলমান চাষী-মজুরদের কল্যাণকামনায় আকুল হয়ে থাকত, সেই অশ্বিনীকুমারের বরিশালে ১৯৫০এর গণ-বীভৎসতার সময় তাঁর স্বজাতি বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায় এই কল্যাণকামনার যোগ্য প্রতিদানই পেয়েছিলো বটে!
কত পরিবার ধ্বংস হয়েছে, কত মায়ের বোনের সম্ভ্রম প্রতিবেশী নেকড়েদের মরুবর্বর সংস্কৃতির কালো পতাকাতলে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব কেউ কোনোদিন জানতে পারবে কি? যাদের নিরন্তর নীরব অশ্রুপাতে স্বয়ং বিধাতার আসনটি পর্যন্ত টলে ওঠেনা, তাদের হয়ে ধর্মের দরবারে ন্যায়বিচারের জন্যে জবাবদিহি করার মত মানুষ আর এই শ্মশানভূমি বাংলায় জন্মাবে কি?
সন্ন্যাসী এগিয়ে চলেন। গন্তব্য মাদারিপুরের খৈয়ারভাঙা গ্রাম।
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে ধসে পড়তে চলেছে একটি বাড়ি। আচমকাই তার মধ্যে থেকে ভেসে আসে নারীকণ্ঠের আর্ত চিৎকার।
কোথা থেকে দেবদূতের মত আবির্ভূত হলো এক বলিষ্ঠ তরুণ। নারীর কান্না শুনে কালবিলম্ব না করে সে ঝাঁপ দিলো আগুনের শিখার মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মা-শিশুকে দুই কাঁধে নিয়ে বিজয়ীর গর্বে ভয়ঙ্কর সেই অগ্নিগহ্বর থেকে বেরিয়ে এলো সে। ক্রুদ্ধ সর্বগ্রাসী পাবকশিখা তার সর্ব অঙ্গে এঁকে দিলো এই দুঃসাহসিক বীরত্বের দুঃসহ পুরস্কারের ছাপ।
সেই ছাপ নিয়েই সে লড়েছে ব্রিটিশের সাথে সম্মুখসমরে। গুরু বাঘাযতীনের সহযোদ্ধা হয়ে, সুদূর বালেশ্বরের কাপ্তিপোদায়।
যদি রাজেন্দ্রলালবাবুর সাথে ওই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের দিনে আমার এই নীরেন দাশগুপ্ত থাকতে পারত, তাহলে আমি সবচেয়ে বেশি ধন্য হতাম গো! খৈয়ারভাঙার আকাশ-বাতাস যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে যায় সন্ন্যাসীর কানে-কানে।
নীরেনেরই আশৈশব বন্ধু, পাশের বাড়ির ছোটো ভাই মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত। "হ্যাঁরে, এই ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে কি ইংরেজের মত এতবড় শক্তিমান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা বুদ্ধিমানের কাজ?" এই প্রশ্নের উত্তরে যে ছেলেটি সেদিন বলেছিল, "আমি বাপু অত-শত বুঝিনা। ...আমি জানি শুধু দাদা আর গদা।", সেই মনোরঞ্জন। এই তো মাত্র কয়েকটা দশক আগের কথা। দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াতে সে জীবন বাজি রেখে গুরু বাঘাযতীনের সাথে লড়তে গেলো বালেশ্বরের মহাসংগ্রামে। ইংরেজ চলে যাওয়ার সময় সেকথা মনে রাখেনি তার মাতৃভূমির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তারা মনে রাখতে চায়না। পাকিস্তানকামী হায়নাদের ভয়ঙ্কর আক্রমণের মুখে মরণপণ লড়াই করা রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর সংগ্রামকে তারা পাকবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের অংশ হিসাবে মেনে নিতে ভয় পায়। ভেবে মনে মনে হাসেন সন্ন্যাসী।
অনতিদূরে আরেক গ্রাম চরমুগুরিয়া। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আদায়ের কাজে এই গ্রামেরই পোস্টঅফিসে ডাকাতি করতে এসেছিলেন পাঁচ বিপ্লবী। ডাকাতি করে ফেরার পথে জনৈক তাহির খাঁ তাঁদের একজনকে ধরে ফেলে। প্রত্যাঘাতে তাহিরকে হত্যা করেন অপর বিপ্লবীরা, কিন্তু তাহিরের ভাইবেরাদরগণ ঢিল ছুঁড়ে মারাত্মক জখম করে বিপ্লবীদের। ধরা পড়েন তাঁরা। বরিশাল জেলের বধ্যমঞ্চে মাত্র বাইশ বছর বয়সে ফাঁসি হয় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের।
এড়ানো যেতনা কি এই মৃত্যু? এরকম দামাল একজন ছেলে বেঁচে থাকলে হয়তো পরে আরো একজন সতীন সেনের মত মহানুভবকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য পেত পূব-পাকিস্তানের অসহায় হিন্দুরা। রাজেন্দ্রলালের অসমাপ্ত লড়াই লড়বার আরেকজন যোদ্ধা পেত বাঙ্গালী হিন্দু সমাজ।
(ক্রমশ).......
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন