অমৃতের সন্ধানে: তৃতীয় পর্ব

 

অমৃতের সন্ধানে: পর্ব ৩


© আমাগো একখান দ্যাশ আসিলো


ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেন সন্ন্যাসী। ফরিদপুরের লোনসিং গ্রামের দিকে। নিজের সময়ে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অস্ত্রবিশারদ, লাঠিসেনাপতি পুলিনবিহারী দাশ এই গ্রামেরই কীর্তিমান সন্তান। কতবার যে তাঁর অনুশীলন সমিতির সভ্যরা পূর্ববঙ্গে মু.সলিম লীগের গুণ্ডাদের হাত থেকে হিন্দুর প্রাণ-মান রক্ষা করেছে তা গুণে শেষ করা যাবেনা। শুধু লাঠিখেলাতেই নয়, ছোরাখেলা, যুযুৎসু ইত্যাদি লড়াইতেও সমান পারদর্শী পুলিনবাবু ছিলেন ব্রিটিশের চোখে মূর্তিমান আতঙ্ক। সুযোগ্য নেতৃত্বগুণে পূর্ববাংলার প্রান্তে প্রান্তে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ৫০০র অধিক শাখাকেন্দ্র। আজ আবারও পূর্ববাংলার দিকে দিকে হিন্দুর প্রাণ-মান রক্ষায় এইভাবে হিন্দুকে দক্ষ হাতে সংঘবদ্ধ করার সংকল্প নিতে কেউ কি এগিয়ে আসবে? কুলকুল শব্দে এই প্রশ্ন করতে করতেই যেন অনতিদূরে বয়ে চলে প্রমত্তা পদ্মা।


সন্ন্যাসী এবার ফিরে চলেন পশ্চিমমুখে। যেতে হবে আরেক নির্ভীক ক্লান্তিহীন যোদ্ধার জন্মস্থলে। কোটালিপাড়া। সতীন্দ্রনাথ(সতীন) সেনের কোটালিপাড়া। যদিও তিনি বেড়ে উঠেছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন আরো দক্ষিণের প্রত্যন্ত জনপদ পটুয়াখালীতে। সেই পটুয়াখালীতেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয় বিদ্যালয়। ১৯২৬ সালে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রার উপর স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মরুবাদীদের হামলার প্রতিবাদে পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের মাধ্যমে হিন্দু সংস্কৃতি পালনের উপর নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে নিষিদ্ধ ইবা*দতের স্থানের সামনের রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রা করে নিত্যদিন গ্রেফতার হতে থাকেন সতীনবাবুর আদর্শে অনুপ্রাণিত যুবকদল। এহেন ঘটনার নজির সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ-আমলের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই‌।


জাতীয় কংগ্রে.সের তরফ থেকে সতীনবাবুকে জানানো হয়, এই জাতীয় 'ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ' দ্বন্দ্বকে অস্বীকার না করলে স্বাধীনতার জন্য মিলিত লড়াই করা যাবেনা। প্রত্যুত্তরে সতীন বলেন, ছোটো বড় প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার যুদ্ধ অগ্রসর হয়, কোনো অন্যায়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলেনা। পুরস্কারস্বরূপ বরিশালের বাইরে অন্য কোনো বৃহত্তর অঞ্চলে কোনো আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে কংগ্রে.সের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে চিরতরে ব্রাত্য হয়ে যেতে হয় তাঁকে।


বরিশালের পোনাবালিয়ার শিবরাত্রির শোভাযাত্রা, বা লাখুটিয়া গ্রামের দোলযাত্রা উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা—একের পর এক হিন্দু পরম্পরার উপর নিষেধাজ্ঞা নেমে আসতে থাকে। সতীনবাবু অটল সংকল্পে সর্বত্র বাঙ্গালী হিন্দুর সংস্কৃতি রক্ষার সৈনিক হয়ে সত্যাগ্রহের পথে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। দিনের পর দিন জেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বন্দী থেকে অজীর্ণতা, ক্ষয়রোগ সহ নানান কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন সতীন। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে চলে যাননি কখনো।


দেশভাগের পর রয়ে গেলেন পূর্ব পাকিস্তানেই। যতক্ষণ পূর্ব পাকিস্তানে একজনও হিন্দু আছে, ততক্ষণ তিনি ভারতে যাবেননা। এই সতীনবাবুকেই ১৯৫০এর বীভৎস হিন্দু নিধনপর্বের সময় পাক-সরকার তাঁকে চাপ দিল, "বরিশালে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছে, কেউ যেন গুজবে কান না দেন" বিবৃতিটিতে সই করতে। সরাসরি অস্বীকার করলেন সতীনবাবু। তৎক্ষণাৎ 'স্বাধীন পাকিস্তান'এর জেলে বন্দী করা হয় তাঁকে। জেলের নিকৃষ্টতম ক্ষুদ্র আলোবাতাসহীন কুঠুরিতে কেটে যায় প্রায় আটটি মাস।


আবার গ্রেফতার হলেন ভাষা আন্দোলনের সময়। একবছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেল ঘুরে অবশেষে মুক্তি পেলেও ১৯৫৪র জুন মাসে আবারও গ্রেফতার হলেন। রংপুর জেলে টিবি রোগীদের ওয়ার্ডের ঠিক তলায় হল তাঁর স্থান। ছাদ ফুটো হয়ে অনবরত তাঁর কুঠুরিতে পড়ছে নোংরা জল। ঠিক করে খেতেও দেওয়া হতনা তাঁকে। অবশেষে এই করে করে শারীরিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি হয়ে একদিন ঢাকার মেডিক্যাল কলেজে ৬১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সতীন সেন। একপ্রকার পাক সরকারের কাস্টডিতেই মৃত্যু হয় তাঁর। তবে শুধু হিন্দুর জন্য নয়, তিনি '৩৯ সালের বিধ্বংসী বন্যায় মু.সলমান-অধ্যুষিত ভোলা দ্বীপেও সর্বস্ব পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সেই নিঃস্বার্থ সেবাকর্মের উপযুক্ত প্রত্যুত্তরই ভোলার অসহায় হিন্দু-আদিবাসী নরনারী পেয়ে চলেছে জ্বী.হাদের ভাষায়, বিগত কয়েক দশক ধরে! অশ্বিনী দত্তের বরিশালের মতই!


এর শেষ কোথায়? সমৃদ্ধিতে উপচে পড়া পৃথিবীর এই সোনার ভূমিতে এত রক্ত-কান্না-মৃত্যুর মিছিলের শেষে নবযুগ-রবি কি কোনোদিনই উদিত হবেনা, হবেনা কি শাপমুক্তি? রাজেন্দ্রলাল...তুমি জয়ী হলে আজ এই নরকদশা দেখার জন্য আমাকে হিমালয় থেকে নেমে আসতে হতনা!


হতাশ মনে পথ চলতে থাকেন সন্ন্যাসী...


এবার গন্তব্য খালিয়া গ্রাম। যে গ্রামের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক-বংশের এক ধর্মপ্রাণ সন্তান একদিন বাঘাযতীনকে প্রশ্ন করেছিলেন, "আচ্ছা, দেশের কাজ করে কি মা-কে পাওয়া যায়?" নিজের যোগ্য সহযাত্রী পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল সাধক-বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথের অন্তর। "তা যদি না পাওয়া যেত, আমায় অন্তত এ-পথে দেখতিস না!"


আর কোনো সংশয়ের বেড়াজালে আটকে থাকেননি সেই সত্যের পথিক। বিপ্লবগুরুর একনিষ্ঠ অনুগামী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ মাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের যুদ্ধে। গভীর রাতে কোন অনন্তের ভাবনায় বিভোর হয়ে খালিয়ার নদী-মাঠ-শ্মশান-কালীবাড়ির নির্জন পরিবেশে হারিয়ে যাওয়া সেই সম্ভ্রান্ত জমিদারবাড়ির সন্তান চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী দেশজননীকে জগজ্জননী জ্ঞানে পূজা করতে গিয়ে আপন রক্ত অঞ্জলি দিলেন বুড়িবালামের তীরে। কিন্তু হায়! এতবড় সাধকের আত্মবলিদান কি তবে নিষ্ফল? পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে যে হিন্দু গৃহজননীদের মানমর্যাদা ধুলোয় মিশে যাচ্ছে দশকের পর দশক— আপন রক্তের অঞ্জলি দিয়ে নতুন করে এই শ্মশানভূমিতে মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়ে তাঁদের পূজার বোধন করতে আর কোনোদিন কি এগিয়ে আসবেনা কেউ?


সন্ন্যাসীর পথচলা যেন শেষ হয়না। এবার তিনি চলেছেন কয়া গ্রামের চাটুজ্যেদের চণ্ডীমণ্ডপে। হ্যাঁ, এই সেই সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথের শৈশবের লীলাভূমি। "আচ্ছা মুখার্জী, তুমি একা হাতে কজনকে ঘায়েল করতে পারো বলো তো?" এরকম প্রশ্নের উত্তরে যিনি সদর্পে বলেছিলেন, "অসংখ্য দুষ্টের দমন আমি একা হাতেই করার সামর্থ্য রাখি", যাঁর সেই মহাপরাক্রমের সামনে বহুবার নতজানু হয়েছে স্পর্ধিত দুর্বিনীত ইংরেজ, তিনি থাকলে হয়তো রাজেন্দ্রলালের লড়াই অত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত না! "He was my right-hand man...And his stature was like that of a warrior"...এমনি এমনি তো যতীন্দ্রনাথের সম্পর্কে এই কথাগুলি বলে যাননি বাংলায় বিপ্লববাদের অন্যতম ভগীরথ ঋষি অরবিন্দ ঘোষ!


প্রথম যেদিন গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখিয়ে সাধক বিপ্লবীকে গ্রেফতার করতে গিয়েছিলেন দুঁদে ব্রিটিশ-প্রশাসক চার্লস টেগার্ট— প্রবল পরাক্রান্ত এই বিপ্লবীর সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। যতীন্দ্রনাথ সহাস্যে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে তুলে ধরে বলেছিলেন—"Beg your pardon, Mr Tegart!"


ইংরেজ লুটেরাগণ চলে গেছে। তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা টেগার্টরাও আর নেই। কিন্তু পূর্ব বাংলায় ভূমিদস্যুদের, হিন্দুর সম্পদ লুটেরাদের দিন তো এখনো শেষ হয়নি। লুটেরা বাহিনী তাদের অনুপ্রেরণার ওহি ভুলে গিয়ে হিন্দুর অঙ্গনে এসে নার্ভাস হয়ে হোঁচট খেয়ে পড়বে—এ একা রাজেন্দ্রলালের স্বপ্ন ছিলনা, এ ছিল বাঘা যতীনেরও স্বপ্ন। সেই হিন্দু আবারও ফিরে আসবে কি?


(ক্রমশ)......



মন্তব্যসমূহ