অমৃতের সন্ধানে: চতুর্থ পর্ব
অমৃতের সন্ধানে: চতুর্থ পর্ব
-অভিরাম গোস্বামী
-সুতীর্থা
© আমাগো একখান দ্যাশ আসিলো
তৃতীয় পর্বের (https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=235389858155789&id=108458550848921) পর:
এবার পদ্মা পেরোতে হবে। গোয়ালন্দঘাট রেলস্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চলেন সন্ন্যাসী। কত ইতিহাস, কত ব্যস্ততা, কত আবেগ এই জড়িয়ে আছে এই রেলস্টেশনটির পরতে পরতে। এখানেই ট্রেনে ওঠার সময় অত্যাচারী ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট অ্যালেন-এর গায়ে রিভলভার ঠেকিয়ে গুলি করেন শিশির গুহরায়। সঙ্গে ছিলেন সত্যেন বসু এবং শচীন ব্যানার্জী। শেষপর্যন্ত সাহেব প্রাণে বেঁচে গেলেও এটিই ছিল ব্রিটিশসিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নবজাগ্রত বঙ্গের প্রথম প্রত্যুত্তর। নাহ, আজকের ভারতবাসী এই ইতিহাস মনে রাখেনি। রাজেন্দ্রলালকেই বা চেনে ক'জন?
পদ্মার উচ্ছল তরঙ্গমালা ভেদ করে লঞ্চ ছুটে চলেছে পাটুরিয়া ফেরীঘাটের দিকে। দিনের শেষে বিদায়ী সূর্য তার অকৃপণ রঙের ভাণ্ডার ঢেলে দিয়েছে পশ্চিম দিগন্তে। দিঙমণ্ডল ব্যাপ্ত করে মুক্তবেণী গঙ্গার আদরের কন্যা পদ্মার জলে এসে উপচে পড়ে সেই রঙের বন্যা। কিন্তু তাও পদ্মা যেন সন্ন্যাসীর কানে কানে বলতে থাকে, ওগো, আমি চিরকাল এমন সুন্দর ছিলামনা! দশকের পর দশক নিঃসহায় হিন্দুর রক্তে কলঙ্কিত হয়েছে আমার এই সৌন্দর্য। কবে হবে আমার এ কলঙ্কিত দেহের শুদ্ধি? আর কতকাল রইব প্রতীক্ষায়? উত্তর দাও, সন্ন্যাসী! তোমরা তো অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সব দেখতে পাও! চুপ করে আছো কেন?
মাথা নিচু করে থাকেন সন্ন্যাসী। এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজেই তাঁর সাধনজীবন ত্যাগ করে মর্ত্যের নারকীয় বাস্তবতার জগতে ফিরে আসা। চুপচাপ বসে বসে ভাবতে থাকেন অতীতের কথা।
ভরা বর্ষায় উত্তাল পদ্মা। নবদ্বীপে কাজীগৃহে অভিযানের সময় শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তদের ত্রিলোকবিদারী হরের্নামৈব কেবলম্ গর্জন সহকারে কীর্তনের সাথেই বোধহয় যৌবনমদমত্তা পদ্মার উদ্ধত প্রবাহের সেই সগর্জন নৃত্যের তুলনা চলে! লঞ্চ-স্টিমার তো দূরের কথা, জাহাজ পর্যন্ত তখন পদ্মা-মেঘনা পার হতে ভয় পায়। কিন্তু ভয় পেতনা একজন। দুর্জয় দুর্নিবার সেই দুস্তর পারাবারের কাণ্ডারীর নাম কালীচরণ মাঝি।
যেন সে সাক্ষাৎ জলদেবতার দূত! এই উন্মত্ত তরঙ্গরাশি কোন যাদুমন্ত্রে যেন বশ মেনে যেত তার কাছে!
"বড্ড দরকার হে কালীচরণ! পারবেনা তুমি আমাদের ওপারে পৌঁছে দিতে?"
"পারুম না ক্যান! উইঠা আসেন নৌকায়!" সঙ্গে সঙ্গে অভয়বাণী শোনায় কালীচরণ।
"কিন্তু যেভাবে আকাশ কালো করে ঝড় উঠেছে—"
"উঠতে দ্যান। আপনেগো বাপ-মায়ের আশীর্বাদে কালীচরণের হাতে যতক্ষণ বৈঠা আছে, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত থাকেন।"
আজকের বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের অ্যাডভেঞ্চারপিয়াসী লঞ্চ লাভাররা কল্পনাও করতে পারবেনা, উত্তাল বর্ষায় ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডবকে হেলায় উপেক্ষা করে কতবার শক্ত হাতে বৈঠা ধরে নিরাপদে যাত্রীদেরকে পদ্মা-মেঘনা পার করে দিয়েছিলো সেই কালীচরণ মাঝি!
আর মাঝির ওপরে সবচেয়ে অগাধ ভরসা যাঁর, তিনি স্থানীয় থানার দারোগাবাবু। কতবার তাঁকে দুস্তর পদ্মা পার করে দিয়েছে এই কালীচরণ! ওর হাতে বৈঠা থাকলে কোনো চিন্তাই নেই।
সময়টা ১৯১০ সাল। বাংলার দিকে দিকে সেদিন জ্বলে উঠেছে বিপ্লবযজ্ঞের হোমাগ্নি। দারোগাবাবুর সামনে এসেছে মস্ত সুযোগ! বিপ্লবীদের গতিবিধি ঠিকঠাক নজরে রেখে বড়কর্তাদেরকে জানাতে পারলে পদোন্নতি আর ঠেকায় কে! আনন্দ আর ধরেনা সেই হেড কনস্টেবল রতিলাল রায়ের।
আচমকাই কোথা হতে বজ্ররবে গর্জে ওঠে আগ্নেয়াস্ত্রঃ দ্রাম্! দ্রাম্! দ্রাম্!
খুন হয়েছেন দারোগাবাবু! শোরগোল পড়ে যায় চারিদিকে! কিন্তু খুনী কে?
খুনী ততক্ষণে নিরুদ্দেশ হয়ে মিশে গেছেন কলকাতার জনসমুদ্রে! কিন্তু তদন্তে এ কী উঠে আসছে! কালীচরণ মাঝিই খুনি?
হ্যাঁ, পরম শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী ত্রৈলোক্য মহারাজ তথা ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীই সেদিনের সেই কালীচরণ মাঝি। যে কালীচরণ মাঝির প্রকৃত পরিচয় কোনোদিন খুঁজে বের করতে পারেনি দুঁদে ব্রিটিশ প্রশাসন!
তবে পরবর্তীকালে অন্যান্য রাজনৈতিক মামলায় বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন, দেশের স্বার্থে জেলে কাটিয়েছেন দশকের পর দশক। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় হিন্দুদেরকে ফেলে রেখে ভারতে চলে আসতে পারতেন 'জননেতা' জ্যোতি বোসের মতই। আসেননি। পুরস্কারস্বরূপ 'স্বাধীন পাকিস্তান'এ আবারও বন্দী হলেন কারাগারে। 'জেলে ত্রিশ বছরঃ পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম' বইটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই নিষিদ্ধ করেছিল পাকিস্তান সরকার।
ময়মনসিংহ জেলে তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীর মর্যাদায় রাখা হলো তাঁকে। পাকিস্তানী প্রশাসক তাদের দেশ থেকে ব্রিটিশ-বিতাড়নে হিন্দুর অবদানকে কবেই বা সেভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে? জেলে ঘুমোবার ব্যবস্থা হলো ফাঁকা মেঝেতে। খাবারের ব্যবস্থা? গতদিনের বাসী ঠাণ্ডা ভাত আর ডাল। মুখে দেওয়ার অযোগ্য। নিজের সাথে নিয়ে যাওয়া মশারিটি পর্যন্ত ব্যবহারের অধিকার পেলেন না। রাতভর মশার কামড় খেয়ে ছটফট করতে হয়, কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুলে উঠে প্রচণ্ড জ্বালা হতে থাকে। জন্মভূমির মুক্তিকল্পে এক হিন্দুর নিঃস্বার্থ আত্মদানের এইই তো উপযুক্ত পাকিস্তানী পুরস্কার!
এই অত্যাচার বেশিদিন সহ্য করতে পারলেননা বৃদ্ধ বয়সে। একদিন অজ্ঞান হয়ে গেলেন। জেলের ডাক্তারদের চিকিৎসা ও যত্নে কোনোক্রমে সুস্থ হয়ে উঠলেন। অবশেষে প্রায় একবছর পর ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে পেলেন মুক্তি।
ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন সন্ন্যাসী। হঠাৎই লঞ্চের শব্দে ঘোর কাটে। এবার নামতে হবে। আপাতত গন্তব্য রমনা ময়দানের অনতিদূরে ঢাকার প্রাচীন বুড়োশিব মন্দির। কেউ কেউ বলেন, এই দেবতা বুড়োশিব নাকি স্বয়ং শঙ্করাচার্য্যের হাতে প্রতিষ্ঠিত। এখানে একসময় অনুশীলন সমিতির সভ্যদের বিপ্লবীজীবনে প্রবেশের দীক্ষাও দেওয়া হত সনাতনী রীতিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মন্দিরের প্রধান সেবাইতসহ শতশত সাধু প্রাণ দিয়েছিলেন খানসেনাদের হাতে।
পথে যেতে যেতে পড়বে শুভাঢ্যা গ্রাম। বিপ্লবী বিনোদবিহারী চক্রবর্তী, মল্লবীর পরেশনাথ ঘোষের স্মৃতিবিজড়িত শুভাঢ্যা। ছেচল্লিশ সালে আগস্টের কুখ্যাত কলকাতা হত্যাকাণ্ডের সময় ঢাকাও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের অত্যাচারে। সুদূর আরবের অনুপ্রেরণাধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে সশস্ত্র জ্বীহাদকর্মীর দল আক্রমণ করে শুভাঢ্যা। কিন্তু তখনও ঢাকার হিন্দুসমাজ দিশাহীন হয়ে পড়েনি। অল্প সময়ের মধ্যেই লীগের গুণ্ডাদের জ্বীহাদের শখ মিটিয়ে দিয়েছিল শুভাঢ্যার তরুণদল। কিন্তু বিনিময়ে লীগের পেটোয়া সরকারের গুলিতে ঝরে গিয়েছিলো তিনটি প্রাণ। সেই গদাধর, ফুলচাঁদ, ক্ষুদিরামের মত ছেলেরা আজ কোন অজানার দেশে হারিয়ে গেছে?
বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে লক্ষ্মীবাজার। যেখানে ছিল পুরনো যুগের ঢাকার নামকরা পালোয়ান অধর ঘোষের আখড়া। এই আখড়াতেই দেহচর্চা করে ভারতবিখ্যাত মল্লবীররূপে নিজেদেরকে গড়ে তোলেন শুভাঢ্যার গৌরব পরেশনাথ। সঙ্গী শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর "ব্রহ্ম সত্য, বুলেট্ও সত্য" নীতি ঢাকার গুণ্ডাদের বাড়াবাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছিলো। শ্যামাকান্ত পরে দেবভূমি হিমালয়ে চলে যান সন্ন্যাসজীবনে দীক্ষা নিয়ে, যাঁকে সোঽহং স্বামী বলেই ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা চেনে। হ্যাঁ, সেযুগের সন্ন্যাসীর গেরুয়া বেশের আড়ালে মুগুর-ভাঁজা, কুস্তি-লড়া এক পালোয়ান থাকত। "সাধু মানেই ভণ্ড" ইত্যাদি উত্তরাধুনিক জ্ঞানগর্ভ বাক্য তখনও হিন্দুদের মধ্যে অতটাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
(ক্রমশ)...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন