পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৪ সালের হিন্দু গনহত্যা

 পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৪ সালের হিন্দু গনহত্যা




"হিন্দুদেরকে আগে ধরো- প্রাণে মেরো না, গায়ের চামড়াটা আস্তে আস্তে তুলে নাও, আমি সেটা দিয়ে জুতো বানাবো..........." - খুলনার কসাই আব্দুস সবুর খান


দেশভাগের পরেও পূর্ব বঙ্গে সাহসী সংঘবদ্ধ নম:শূদ্র হিন্দু জনগোষ্ঠী খুলনা,ফরিদপুর অঞ্চলে প্রতিপত্তির সাথেই বসবাস করছিলো। যা কোনভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী জনতা মেনে নিতে রাজী ছিলো না। কিভাবে এই মার্শাল রেস অফ বেঙ্গল(উইলিয়াম হান্টার এই নামকরণ করেছিলেন) তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সবংশে নিঃশেষ করা যায়,সেই সুযোগ খুঁজছিলো। অবশেষে,১৯৬৪ সালে কাশ্মীরের এক মসজিদে পয়গম্বরের চুল চুরি যাওয়ার গুজবকে কেন্দ্র করে,তাদের অভীষ্ট সিদ্ধি হয়। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙ্গালী হিন্দুদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য তাদের উপর চালানো এক নিষ্ঠুর অমানবিক গনহত্যা ১৯৬৪ সালের পূর্ব- পাকিস্তান দাঙ্গা নামে পরিচিত। আজ সেই অভিশপ্ত ২৭ শে ডিসেম্বর। এই গনহত্যার একটি বিশেষ লক্ষণীয় দিক হল-ঢাকার এবং পূর্ব-বাংলার অন্যান্য শহরাঞ্চলের যে সব নির্দিষ্ট এলাকাতে হিন্দু জনগোষ্ঠী সংখ্যাবহুল সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় এবং হিন্দু মালিকানাধীন কলকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়। খুলনায় ও পরে ঢাকায় আদমজী ও বাওয়ানি জুট মিলের উর্দুভাষী মুসলমানরা দাঙ্গা শুরু করে। কিছু বাঙলাভাষী মুসলমান শ্রমিকও তাতে যােগ দেয়। এই দুটি জুট মিলের চারপাশে ছিল হিন্দুদের গ্রাম। তৌহিদী জনতা ক্ষিপ্ত কুকুরের মতাে সেই সব গ্রামের হিন্দুদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খুন করে ও লুট করে হিন্দুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।


ফলশ্রুতিতে আরও একবার বাঙ্গালী হিন্দু শরণার্থীদের ঢেউ আছড়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের উপর। হাজার হাজার হতভাগ্য অসহায় শরণার্থীর ঢেউ আছড়ে পরে প্রতিবেশী ভারতের উপরে। প্রতিদিনই ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ আর্ত হিন্দু সর্বস্ব ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেশান্তরী হবার উদ্দ্যেশ্যে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে জড় হত। কিন্তু মাত্র ৩০০-৪০০ ভাগ্যবান হিন্দুই ভারতে প্রবেশের অনুমতি লাভে সমর্থ হত। অন্তহীন দেশান্তরের কারণে পূর্ব-পাকিস্তানের একমাত্র হিন্দু গরিষ্ঠ জেলা খুলনাও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাতে রূপান্তরিত হয়। পূর্ব-পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ছিটমহল গুলোতে পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনের ফলে বিশাল পরিমানে হিন্দু শরণার্থী ভারতের জলপাইগুড়িতে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। ২ রা মার্চ 'দ্যা গ্লোব এ্যান্ড মেইল'(The Globe and Mail) তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে,ঢাকার হাজার হাজার নিরুপায় হিন্দু ভারতে যাবার জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এক হিসাব থেকে জানা যায়,শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই কমপক্ষে ১,৩৫,০০০ হিন্দু শরণার্থী প্রবেশ করেছে। এই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নারায়ণগঞ্জের পানাম নগরের সকল হিন্দু পালিয়ে ভারতে চলে যায়। এই আশ্রয়প্রার্থী পীড়িত-নির্যাতিত হিন্দু শরণার্থীরা ভারতের জাতীয় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়। তৎকালীন জহরলাল নেহেরুর সরকার পূর্ববাংলার এই নিপীড়িত হিন্দুদেরকে মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। 


১৯৬৩ সালের ২৭শে ডিসেম্বরে কাশ্মীরের শ্রীনগরে অবস্থিত হজরতবাল দরগা শরীফে সংরক্ষিত নবীর মাথার চুল চুরি হয়ে যাওয়ার গুজব রটে। সেজন্য ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে ব্যপক বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। আব্দুল হাই নামে ইসলামিক বোর্ডের উপদেষ্টা কমিটির একজন সদস্য পূর্ব পাকিস্তানের পৌত্তলিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার ডাক দেয়। সেই দাঙ্গার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আয়ুব খান স্বয়ং। দাঙ্গা শুরু হবার আগের

দিন ইসলামাবাদে ফেরার পথে ঢাকার বিমান বন্দরে তিনি ঘােষণা করলেন যে, কাশ্মীরে চুল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে যদি কোনাে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তবে তাঁর পক্ষে কিছু করার থাকবে না।পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগ ১৯৬৪ সালের ৩রা জানুয়ারী কে ‘কাশ্মীর দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬৪ সালের ৪ রা জানুয়ারিতে হারিয়ে যাওয়া চুল খুঁজে পাওয়া গেলেও পরেরদিনই পাকিস্তান রেডিও থেকে ওই ঘটনাকে মিথ্যা বলে প্রচার করা হয়। সে ঘটনার সূত্র ধরে খুলনা,ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা জেলা, রাজশাহী, সিলেট ও ময়মনসিংহ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। হিন্দুজনগোষ্ঠীর উপর দমন পীড়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন পাকিস্তান ততকালিন সরকার। বাঙ্গালী হিন্দুদের পূর্ববঙ্গ ত্যাগ,আদিবাসীদের উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হয়।


খুলনা :- পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় যোগাযোগমন্ত্রী আব্দুস সবুর খান ১৯৬০ সালে খুলনা জেলার মাটিখালীর একজন সম্ভ্রান্ত হিন্দু ভূমিধ্যিকারী রূপচাঁদ বিশ্বাসের ৩০ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয় এবং সেখানে একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করে। রূপচাঁদ বিশ্বাস আব্দুস সবুর খানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় সবুর খান পরাজিত হয় এবং আদালত তাকে ১,৩৫,০০০ রুপি পরিশোধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সবুর খান বিচারালয়ের বাইরে এই দখলবাজির মীমাংসা করতে চাইলেও রূপচাঁদ তা দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখান করেন। এর মাঝেই মজিদ মিয়াঁ নামে সবুর খানের মনোনীত প্রার্থী জেলা পরিষদ নির্বাচনে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। সবুর খান ও চামকুরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহ তাদের দলের অন্যান্য সদস্যরা এই পরাজয়ের কারণ হিসেবে হিন্দুদেরকে দায়ী করে এবং হিন্দুদের প্রতি হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতে শুরু করে। এই অবস্থার মধ্যেই হজরতবাল ঘটনার গুজব ছড়ানো হয়। সবুর খান খুলনায় হিন্দু নিকেশের জন্য এই সুযোগটি দ্রুত লুফে নেয়। ১৯৬৪ সালের ২ রা জানুয়ারি তারিখে হজরতবাল ঘটনার প্রেক্ষিতে মুসলিমরা হিন্দুদেরকে পায়ে জুতো পরতে, মাথায় ছাতা ব্যবহার করতে কিংবা রিকশায় চড়তে বাধা দেয়। মধ্যাহ্নে মুসলিমরা সমগ্র খুলনাব্যাপী মিছিল বের করে এবং মিছিল থেকে হুঙ্কার আসতে থাকে, ‘হিন্দুদেরকে হত্যা কর’। বিকাল চারটার দিকে খুলনায় হিন্দু নিধন শুরু হয়। টানা চার ঘণ্টা এই বীভৎস ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির পর রাত আটটায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এই তীব্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মাঝেই পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ৩ রা জানুয়ারিকে ‘কাশ্মীর দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। খুলনায় সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে পরিস্থিতিকে আরও বিভীষিকাময় ও সন্ত্রস্ত করে তোলার প্রয়াস চালানো হয়। খুলনার এক প্রান্তে দৌলতপুর শিল্প এলাকায় এক বিশাল জনসভায় আব্দুস সবুর খান বক্তব্য প্রদান করে। হাজার হাজার তৌহিদী ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে এই উস্কানিমূলক বক্তব্য শ্রবণ করে। সবুর খান এই সুযোগে হিন্দু বিদ্বেষী এবং ভারত বিরোধী জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করে। তৎক্ষণাৎ সেই সমাবেশ থেকে প্রায় ২০,০০০ মুসলিম জনতা সেনহাটি ( দিঘলিয়া উপজেলা), মহেশ্বরপাশা, পাবলা,চন্দনীমহল, দৌলতপুরসহ আশেপাশের হিন্দুপ্রধান জনবসতি গুলোর উপর তীব্র আক্রোশে আক্রমণ শুরু করে সেখানকার হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মস্থান লুট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে তারা। প্রচুর হিন্দুকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে একটি দল সড়ক ও রেলপথ ধ্বংস করতে করতে সন্ধ্যায় খুলনা শহরে উপস্থিত হয়। পরবর্তী চার দিন খুলনার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর লাগামহীন হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, লুণ্ঠন, ধ্বংসের এক বন্য বীভৎসতা চলে। খুলনা শিপইয়ার্ড , দাদা কোম্পানি, ইস্পাহানী কোম্পানি, কাটা কোম্পানি, সোলম্যান কোম্পানিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার মুসলিম শ্রমিকরা হিন্দুদের উপর এই জঘন্য,অমানবিক জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করে। লোপপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এদেরকে মারণাস্ত্র সরবারহ করে এই পাশবিক হিন্দু নিধনকে উৎসাহিত করে। খুলনা লঞ্চঘাটে কমপক্ষে ২০০-৩০০ হিন্দুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। খুলনা থেকে চালনা পর্যন্ত রাস্তার দু’দিকে থাকা প্রতিটি হিন্দু জনপদ, গ্রাম ধ্বংস করা হয়।


ঢাকা:- জানুয়ারি মাসের ১৩ তারিখে ঢাকা স্টেডিয়ামে হজরতবাল ঘটনার প্রেক্ষিতে মুসলিমরা একটি জনসভা আয়োজন করে। জানুয়ারির ১৪ ও ১৫ তারিখে চট্টগ্রাম ও সিরাজগঞ্জ থেকে আগত ঢাকাগামী ট্রেনের হিন্দু যাত্রীদেরকে টঙ্গী ও তেজগাঁও নেমে যেতে বলা হয়। ১৫ তারিখে একদল হিংস্র জনতা ২০,নবাবপুর রোডের

পুরোহিতের বাড়িতে ঢুকে রাধা- কৃষ্ণ মন্দির ধ্বংস করে এবং পুরোহিতের গলা কেটে মুণ্ডচ্ছেদ করে। বাড়ির আরও চারজন পুরুষ সদস্যকেও একইভাবে হত্যা করে উল্লাস করে তারা। নবাবপুরের বিখ্যাত দাস স্টুডিও লুটপাট করে তারা এবং আগুনে পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ভস্মে পরিণত করে। ১৫ জানুয়ারি রাতে নগরখানপুরের প্রত্যেকটি হিন্দু বাড়িতে একই ভাবে আক্রমণ করে এবং লুটপাট-রাহাজানি শেষে ধ্বংস করে দেয় সেগুলো। ১৫ জানুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে টিকাটুলির রামকৃষ্ণ মিশন আক্রমণ করে মুসলিমরা। পূর্ববঙ্গের রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয় এই মঠের তিনটি ভবন, সাতটি আধাপাকা বাড়ি, একটি মন্দির, একটি দাতব্য চিকিৎসালয়, একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার, একটি সুখ্যাত ছাত্রাবাস সম্পূর্ণ রূপে ধুলিস্যাত হয় সহিংস তাদের হিংস্রতায়।

জানুয়ারির ১৬ তারিখে সেন্ট্রাল ব্যাংকে কর্মরত কৃষ্ণ দে, ইউনাইটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংকে কর্মরত প্রাণ কুমার দে, বরদা ব্যাংকে কর্মরত আরও একজন হিন্দু কর্মকর্তা ব্যাংক চত্বরে দুই দিন লুকিয়ে থাকার পর গাড়িতে করে পালানোর সময় মুসলিমরা তাদের গাড়ি থামিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে। এফ.এম.ই. স্কুল,পাবলিক লাইব্রেরী , বিবেকানন্দ ফিজিক্যাল ক্লাব, হিরালাল লহিয়া চ্যারিটেবল হসপিটাল সহ

আরও অনেক প্রতিষ্ঠান তৌহিদীরা আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দেয়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ট্রাকে ভরে ভরে মৃতদেহগুলো হাসপাতালে নিয়ে আসে তারা এবং সেগুলো সেখান থেকেই সরাসরি নিয়ে মাটি চাপা দেয়া হয়।এভাবে শতশত হিন্দুর মৃতদেহ সেনাবাহিনী গুম করে ফেলে।

এমনকি যে সকল মৃতদেহ শনাক্ত হয়েছিল সেগুলোকেও তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে গুম করে ফেলে তারা। রায়েরবাজারের প্রতিটি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। কমপক্ষে ৯৬ জন হিন্দুকে সে সময়ে পাশবিক উপায়ে হত্যা করে তারা। অনেক হিন্দু মহিলাকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণ করে এবং অসহায় হিন্দু বালিকাদের অপহরণ করে। ১৮ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিবেদন করে, পুরনো ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের ৯৫ শতাংশ বাড়ি-ঘর ধ্বংস করে দিয়েছে মুসলিমরা। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ১,০০,০০০ হিন্দু আশ্রয়স্থল হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাই নিয়েছে। ২৩ শে জানুয়ারি দ্য হিন্দু প্রতিবেদন করে,পাকিস্তানের সরকারী হিসেবেই ঢাকা শহরে ১০০০ এর উপর হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে গত এক সপ্তাহে। যদিও একজন অ্যামেরিকান শান্তিরক্ষী সেনাবাহিনীর নার্স বিবৃতি দেন,শুধুমাত্র ২১ শে জানুয়ারিতেই তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কমপক্ষে ৬০০ মৃতদেহ দেখতে পান।


রাজশাহী :- তৎকালীন রাজশাহী জেলার নওগাঁর নিকটে অবস্থিত মইনাম গ্রামের সকল হিন্দু গ্রামবাসীকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয় শুধুমাত্র দুটি নাবালিকাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। দুরুশা নামক স্থানের সাঁওতাল আদিবাসী সম্প্রদায়ও হিন্দু বিরোধী এই পাশবিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়।


সিলেট :- সিলেটে রমযান মাসে হিন্দুসম্প্রদায়ের সকল দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়, কীর্তনসহ অন্যান্য ধর্মানুষ্ঠান নিষিদ্ধ করে দেয় বিরামহীন হিংসার প্রকাশ ঘটায় । সিলেটের ৩৫ টি চা বাগানের সকল হিন্দু শ্রমিকদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য হুমকি দেয়া হয়, তাদেরকে গো-মাংস ভক্ষনে বাধ্য করা হয়। বাসুদেব শর্মা নামে একজন অত্যন্ত সজ্জন হিন্দু গুরু ছিলেন,যিনি সেখানকার হাজার হাজার হিন্দু শ্রমিকদের নিকট অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ঈদউল- ফিতরের দিনে নিরীহ এই

মানুষটিকে মুসলিমরা জোর করে গো-মাংস ভক্ষণে বাধ্য করে।


ময়মনসিংহ :- তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নালিতাবাড়ী, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর , হালুয়াঘাট, শ্রীবরদী এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসী গারো এবং হাজং জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হয়। ফলে তাদের অনেকেই হাজার হাজার বছর ধরে আঁকড়ে থাকা স্বভূমি ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। জয় ভীম-জয় মীম ঐক্যের গাজরে ভোলোর আগে মনে রাখবেন।


সেই অন্ধকার দিনের এক প্রত্যক্ষদর্শী,যার আদি বাড়ি ছিল বরিশাল। ৯৬ এর দাঙ্গায় বসত বাড়ি পুড়ে ছারখার হয়ে গেলে ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন।পরে মাটির টানে ফিরে যান বাংলাদেশে '৯৯ তে - বর্তমানে পুরান ঢাকায় থাকেন। "আমি বলতে পারি, কিন্তু আমার নাম প্রকাশ করো না - এক ছেলেকে হারিয়েছি, আরেক ছেলে অনেক কষ্টে এক সংসার বেঁধেছে - আমি আর কাঁদতে চাই না"। নাম না প্রকাশের আশ্বাস পেয়ে তিনি বলতে থাকলেন, "সেদিন , সেদিনের ঘটনা আমি কখনো ভুলবো না - আমি নেহাতই তখন বালক মাত্র - বাবার সাথে ধানের খেতে যেতাম, কিছুক্ষন পর এক চাচা এসে খবর দিলেন বাবাকে যে যেন আমরা এখনই গ্রাম ত্যাগ করি I ওই চাচা ছিলেন আমার পিতার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু - এবং তিনি শুনেছেন যে কিছু লোক "হিন্দু দেখলেই কাইটা দিমু" বলতে বলতে আসছে। বাবা আমায় নিয়ে তৎক্ষণাৎ বাসার দিকে রওনা হন। তবে পথে আসে এক মরণাপন্ন করার মতো বাঁধা - আমাদের একটু দূরেই এক দল দাঙ্গা কারী মারতে মারতে আসছিলো একজন হিন্দুকে - আমি চিনতাম তাকে - পাশের পাড়ায় সে নাপিতের কাজ করতো. একজন ওয়েস্ট পাকিস্তানী সেনাও ছিল পাশে দাঁড়িয়ে, একটি পোষা মিলিটারি এলসেশিয়ান বা দোভারম্যান জাতীয় কুকুরের গলার চেন ধরে। আমায় নিয়ে বাবা বেগতিক দেখে সামনে এক ভাঙা চোরা দোকানের কপাটের ধারে লুকিয়ে পড়েন - তারা ওপারে জোর গলায় তখন বলে চলেছে, যে মালাউনের বাচ্চা, তোর আব্বাদের বলিস না কেন শালা, যে আমাদের না রাগাতে?! তোকে এবার কাটাচ্ছি ... এই বলে তার শরীরের পেছন দিকে কোদালের দুই তিন কোপ মারে তারা, কাতর ভাবে আর্তনাদ করে সে যখন মাটিতে আছড়ে পরে, পাশে মিলিটারি সাহেবের কুকুরের গায়ে তাকে তুলে ফেলে দেয় - বেশিক্ষন লাগে না, একটু একটু করে.. সেই প্রাণী ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষটির উপর, ছিঁড়ে ছিঁড়ে তুলে নিতে থাকে, তার চোখ, গলার নলির অংশ.. বাবা আমার চোখ ও মুখ চেপে ধরেন, ঈশ্বর সহায়- সৌভাগ্যবশত পরিত্যক্ত দোকানটির পেছনে এক খোলা দরজা দেখে বাবা আমায় নিয়ে সে দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন.. ঢাকায় আমার এক উকিল কাকার বাসায় সেদিন এসে ৫ মাস আশ্রয় নি সেদিনই.., ভুলবো না.. সে বীভৎস দিন আমি ভুলবো না..." বলতে বলতে তার দুই চোখ ভিজে আসলো.......



তথ্যসূত্র:-


১. Across Border, Shubhashree Chowdhury


২. "Moslem-Hindu Violence Flares Again",Thomas F Brady (৫ই এপ্রিল,১৯৬৪)


৩. "1,000 KILLED IN RIOTS"। The Hindu। Madras। ২৩ জানুয়ারি ১৯৬৪।


৪.  Partition, Bengal and After: The Great Tragedy of India, Kali Prasad Mukhopadhyay


৫. The Daily Ittefaq। Dhaka। জানুয়ারি ১৮, ১৯৬৪।


৬ . Empire's Last Casualty: Indian Subcontinent's vanishing Hindu and other Minorities,Sachi Ghosh Dastidar


৭.Genocide in East Pakistan/Bangladesh,S K Bhattacharya


৮.বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালে শেখ মুজিব,ড. কালিদাস বৈদ্য


৯.চিত্রা নদীর পারে, তথ্যচিত্র,তনভীর মোকাম্মেল

মন্তব্যসমূহ