বাঙ্গালী বামপন্থা ও পাকিস্তান প্রস্তাব
কম্যুনিস্ট পার্টির বিখ্যাত নেতা প্রশান্ত শূরের বাবা নগেন্দ্রকুমার শূরকে নিজের হাতে নিজের কবর খুঁড়তে বাধ্য করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ‘এক বৃন্তে দুইটি কুসুম’-এর একটি ‘কুসুম’-এর দল। প্রশান্ত শূর পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। কলকাতার মেয়র হন এবং পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী হন।
কিন্তু, এই কমিউনিস্ট নেতা অন্যান্য অনেকের মতোই ডিনায়াল মোডেই থাকতেন। উদ্বাস্তু নিয়ে জ্ঞান দিতেন প্রচুর, সম্প্রীতির গল্পও করতেন। তবে তাঁর বাবার প্রসঙ্গ উঠলেই চুপ করে যেতেন। 😊 (১,২)
***
“ভারতের মুসলমানরা এক স্বতন্ত্র জাতি”
স্যার সৈয়দ আহমেদ খান যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবর্তন করেন, ‘কবি-দার্শনিক’ মুহম্মদ ইকবাল যখন ‘মুসলমানদের পৃথক ভূমি’ দাবি করেছিলেন; তাঁদের প্রত্যক্ষ সমর্থন করেছিল কমিউনিস্টরা। কমরেড মোহিত সেন তাঁর আত্মজীবনী ‘A Traveller and the Road’-এ এমনকি এও লিখেছেন যে, পাকিস্তান দাবীর পক্ষে মুসলিম লীগের চেয়েও ভালো ওকালতি করেছিল তাঁর নিজের দল, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি!
কমিউনিস্ট পার্টি মনে করত মুসলিম লীগের তোলা পাকিস্তান দাবি ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত। কারণ নাকি ওই দাবীর পেছনে রয়েছে ‘গরীব’ মুসলমানদের “আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার”! ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘People's War’ পত্রিকায় কমরেড গঙ্গাধর অধিকারী কলম ধরলেন পাকিস্তান দাবীর সমর্থনে। “Recognition of the right of separation of individual nationalities”!
হ্যাঁ, ‘Right of separation’ খাঁটি বামপন্থী তত্ত্ব। যত্রতত্র কমিউনিস্ট নেতাদের মদতে ওঠা ‘ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে, ইনশাআল্লাহ ইনশাআল্লাহ’ স্লোগান কোনো বিচ্ছিন্ন স্লোগান বা ‘অতিবাম এলিমেন্টের দ্বারা দেওয়া অবাঞ্ছিত স্লোগান’ নয়; বিশুদ্ধ ‘অধিকারী তত্ত্ব’। মুসলিম লীগের হাত ধরে উগ্রবাদীদের সঙ্গে যে রোমান্স কমিউনিস্টরা শুরু করেছিলেন আব্বাস সিদ্দিকীর সময়ে তা ফুলশয্যায় পরিণত হয়েছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, বরং প্রতিটি সত্যিকারের প্রেমের এই পরিণতি হওয়াই তো স্বাভাবিক, নাকি?
১৯৪৭ সালের প্রথমদিকে ‘হাউজ অব কমনস’-এ ভারতের স্বাধীনতা ও আইন সংক্রান্ত আলোচনার সময় জিন্নাহর পাকিস্তান দাবীর সমর্থন করে কম্যুনিস্ট নেতা কেনি জিলিয়াকাস বলেছিলেন, “new Indian Constitution should make provision for sub nationalities.” এবং কমিউনিস্টদের এই বক্তব্য সর্বতোভাবে সমর্থন করেন বাঙ্গালী বিদ্বেষী, অত্যাচারী, ভারতের স্বাধীনতার শত্রু উইনস্টন চার্চিল। ভারতকে টুকরো করার প্ল্যানে সামিল ছিল লীগ-কমিউনিস্ট-চার্চিল জোট। (২)
পাকিস্তান দাবীকে সমর্থন করে ‘গণসঙ্গীত’ও লিখে ফেলেছিলেন কমিউনিস্টগণ। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর আত্মজীবনী “উজান গাঙ বাইয়া”তেও এই কথা স্বীকার করে গেছেন। মুকুন্দদাসী সুরে তিনি নিজেই লিখেছিলেন,
“দেশের ভাব দেখিয়া মরি,
ভাবের অভাব হৈল দেশে
ভাইয়ে-ভাইয়ে বিবাদ করি
….শােন কংগ্রেস নেতাগণ
মুসলমানের আত্মশাসন
না মানিলে হয় না মিলন
দেখ চিন্তা করি।” (৪)
এটা নিশ্চয়ই জানেন যে, বঙ্গীয় প্রাদেশিক নির্বাচনে পাকিস্তান দাবী নিয়ে নির্বাচনে লড়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আব্দুল হাসিমকে ম্যানিফেসতো লিখতে সাহায্য করেন কমিউনিস্ট নেতা নিখিল চক্রবর্তী। (৫)
কিন্তু, ন্যাক্কারজনক কাজের সীমা ছাড়ালো যখন কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা যোগ দিলেন ডাইরেক্ট একশনের ‘মিছিলে’! ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগের ডাকা মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। কলকাতা হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী মিজানুর রহমান ‘কৃষ্ণ ষোলোই’ বইতে অনুমান করেছেন যে, শ্রমিক ইউনিয়নের এক বিশাল অংশ মুসলমান হওয়ায় এবং তাদের পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন থাকায় কমিউনিস্টরা এই নীতি নিয়েছিল। (২)
কিন্তু, এতকিছুর পরেও সাম্প্রদায়িক হিসেবে আক্রমণ করা হয়েছিল কাদের, জানেন? হ্যাঁ, হিন্দুদেরই। দাঙ্গায় হিন্দুরা ঘর হারালো, দাঙ্গায় হিন্দু মেয়েরা সম্মান হারালো, দাঙ্গায় হিন্দুরা জীবন দিল। অথচ, কমিউনিস্টদের প্ররোচনায় যখন সাম্প্রদায়িকতাকে আক্রমণ করে, তখন শুধুমাত্র আক্রান্ত হয় হিন্দুরা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত সলিল চৌধুরীর “মাংসাশীর জন্য বিজ্ঞাপন” কবিতাটি।
“আসুন! আসুন! কার তাজা মাংস চাই
হাতে যেন থাকে খাঁটি খদ্দরের থলি
ভীষণ সস্তা মাংস নিয়ে যান ভাই
অহিংসার হাড়িকাঠে দিয়েছি এ বলি,
পরম সাত্ত্বিক মাংস গঙ্গাজলে ধােয়া
রামধুন গেয়ে-গেয়ে তবে বলি দেওয়া।”
রামধুন, খদ্দর, অহিংসা, গঙ্গাজল, পরে 'তিনরঙা খাঁড়া শব্দের ব্যবহারে বােঝা যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য শুধু কংগ্রেস ও হিন্দু সম্প্রদায়কেই আক্রমণ করছেন এই কবি। শেষ দুই চরণে বলা হয়,
“ভয় নেই আমাদের মাংস নিরামিষ
সর্বত্রই ব্রাঞ্চ আছে দিল্লি হেডাপিস।” (২)
বাম মনোভাবাপন্ন কবি শ্রীজাত হোক বা বাম (বর্তমান তৃণ) শিল্পী সায়নী–যেকোনো অজুহাতে হিন্দুদেরকেই দায়ী করে তাদের ধর্মকে বিদ্রুপ করার এই যে ট্র্যাডিশন, সে চলে আসছে অনেক দিন থেকেই।
তত্ত্বের দায়ে, পার্টির ছুঁড়ে দেওয়া হাড়ের লোভে, ‘শিল্পী’রা বিকৃত করেছেন সত্য। সেই কবে থেকেই…
“পথের কাঁটা” গল্পে রমেশচন্দ্র সেন দুটি সমান্তরাল মিছিলের কথা বলেছেন, বাক্স পেটরা হাঁড়িকুড়ি বিছানার যােজনব্যাপী বিরাট কিন্তু বিচ্ছিন্ন মিছিল; একটা চলেছে পুব থেকে পশ্চিমে, অন্যটা পশ্চিম থেকে পুবে। দুই দিকগামী দুই দল “সামনে আসিয়া একদল আরেক দলের দিকে চাহিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। দু-দলের দৃষ্টিই শান্ত, স্থির, তাতে হিংসা নাই, দ্বেষ নাই। তাহাদের চোখে শুধু একটি প্রশ্ন, তােমাদেরও এই দশা ভাই? এ করল কে? কারা? প্রশ্নের সঙ্গে ছিল সহানুভূতি, মানুষে-মানুষে দরদ।” লেখক দেখাতে চেয়েছেন মানুষে-মানুষে দরদ ছিল, তাই বাস্তবের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন মেকি হৃদয়বত্তা। কিন্তু সেদিন ছিল না ভ্রাতৃত্ববােধ, দৃষ্টি সেদিন ছিল না শান্ত, হিংসাবিদ্বেষহীন।
একই ধরনের গল্প মনােজ বসুর “এপার-ওপার”। দেশত্যাগী হিমাংশুর মাঠের ধান তাজ মহম্মদ দখল করেছিল। দেশে গেলে হিমাংশুকে অবাক করে তাজ মহম্মদ তাকে ধানের দাম হিসেবে ১০০ টাকা দেয়! আর হিমাংশু, তার মতো সহায় সম্বলহীন মানুষের পক্ষে এই উদারতা অনুচিত জেনেও, সেই টাকা গোলাম আলীকে দিয়ে দেয় দরগা বানানোর জন্য! এর চেয়ে বরং তিমিকে উড়তে দেখালে কম তথ্যবিকৃতি ঘটতো।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘স্বাক্ষর’, সমরেশ বসুর ‘আদাব’, ভীষম সাহানির ‘তমস’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ইজ্জত’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খতিয়ান’ ইত্যাদিতে যেন গল্পের গরুটি গাছে ওঠার পর ফ্লাইং সসার চালানোও শিখেছে।
এইরকম বানোয়াট মিথ্যে লেখার চেয়ে বরং যাঁরা নীরবতা পালন করেছিলেন তাঁরাই বেশি সৎ।
আমাদের হিন্দু গণহত্যা একমাত্র “ইউরোপের ইহুদী বিতাড়ন এবং হলোকাস্ট”-এর সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু, ইউরোপ সত্যের মুখোমুখি হয়েছে। আর আমাদের দেশে? কার্পেটের তলায় চালান করা হয়েছে ইতিহাসকে। সেন্সর করা হয়েছে সবকিছু। রাষ্ট্রীয় মদতে হিন্দুদের ওপর হওয়া অত্যাচারের কাহিনীকে সেকুলারিজমের জুজু দেখিয়ে চেপে দেওয়া হয়েছে। তাতে ‘মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম’বাজারী ঠিকঠাক হলেও, হয়নি সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোনো সমাধান।
ইতিহাস পড়তে হবে। ইতিহাস চর্চা করতে হবে। জ্ঞান হোক মুক্ত। তবেই একমাত্র এই সমস্যার মূলে পৌঁছানো যাবে এবং হয়তো সমাধানের চেষ্টা করা যাবে। ডিনায়াল মোডে থাকা সম্প্রীতির স্বপ্নপুরীর বাসিন্দাদের জন্য এটাই বলা যায়, ‘অন্ধ হলে প্রলয় কি যায় থেমে?’
তথ্যসূত্র:
১) The Marginalization of Bengal, সোমদত্তা মন্ডল।
২) ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য, অশ্রুকুমার সিকদার।
৩) A Traveller and the Road, মোহিত সেন
৪) উজান গাঙ বাইয়া, হেমাঙ্গ বিশ্বাস
৫) Brothers against the Raj, Leonard A. Gordon
৬) পথের কাঁটা, রমেশচন্দ্র সেন
৭) এপার-ওপার, মনােজ বসু
৮) স্বাক্ষর, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
৯) আদাব, সমরেশ বসু
১০) ইজ্জত, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
১১) তমস, ভীষম সাহানি
১২) খতিয়ান, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল
Excellent 👍👍
উত্তরমুছুনOsadharon
উত্তরমুছুন🙏🙏🙏
উত্তরমুছুনসত্যিই, ভাবতে অবাক লাগে বিশ্বাসঘাতকতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল বা আজও আছে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ এত সুন্দরভাবে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য। 🙏
উত্তরমুছুন