প্রান্তিক মানব

 

শুরু করতে চলেছি আমাদের নতুন সিরিজ #অন্ধকারের_দিনলিপি 

এই সিরিজে আমরা উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে লেখা বিখ্যাত বইয়ের কিছু অংশ তুলে ধরবো এবং লেখক ও বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেবো।

সম্ভব হলে ওই বইগুলো কোথা থেকে কিনতে পাওয়া যাবে তার সন্ধানও দেবো। (না, কোনো পেইড প্রমোশন নয়। আপনারা যেখানে ইচ্ছা সেখান থেকে কিনতে পারেন। )


প্রথম পর্বে আজ বলবো শিক্ষক ও গবেষক প্রফুল্লচন্দ্র সেনের লেখা “মার্জিনাল মেন” বা “প্রান্তিক মানব” বইটির কথা। 


এ বইয়ের লেখক প্রফুল্ল চক্রবর্তী ছিলেন পেশায় শিক্ষক-গবেষক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত আগে থেকেই যে অজস্র উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় খুঁজছিলেন, তাঁদের হাল-হকিকত জানার জন্য ব্যস্ত ছিলেন বহুদিন থেকেই। ১৯৭৮ সালে তিনি উদ্বাস্তু শরণার্থীদের নিয়ে বই লেখার সিদ্ধান্ত নেন এবং স্বভাবতই প্রথমে খোঁজ পড়ে প্রামাণ্য রেফারেন্সের। বলা বাহুল্য যে, পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যা সত্তরের দশকেই প্রথম দেখা দেয়নি, স্বাধীনতার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহু শরণার্থী চলে আসতে শুরু করেন। অথচ প্রায় তিরিশ বছরের ইতিহাসকে জানার জন্য তাঁর কাছে সাকুল্যে রেফারেন্স ছিল তিনটি – ১) হিরণ্ময় ব্যানার্জ্জী, শরণার্থী ত্রাণ বিভাগের পুনর্বাসন কমিশনার হয়ে কাজ করার সময়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, তার অবলম্বনে লিখেছিলেন ‘উদ্বাস্তু’, ২) ১৯৪৮ সালের তথ্য অবলম্বনে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিউট থেকে প্রকাশিত একটি সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা ‘The Uprooted’, যার লেখক ছিলেন কান্তি পাকড়াশী এবং ৩) উদ্বাস্তু কলোনির ইতিবৃত্ত নিয়ে লেখা ‘পশ্চিম বাংলার জবরদখল উদ্বাস্তু উপনিবেশ’ (অনিল সিনহা)। কিন্তু এগুলোর কোনোটিকেই প্রামাণ্য রেফারেন্স বলা চলে না, এবং সব কটি একত্রে ধরেও সার্বিক চিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এমত অবস্থায় একজন গবেষক কী করতে পারেন? উত্তর পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু প্রফুল্ল চক্রবর্তী যা করলেন সেটা ভাবাটাও বেশ দুষ্কর ব্যাপার – বারো বছর ধরে উনি চষে ফেললেন সারা ভারত, পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীরা যেখানে যেখানে আশ্রয় খুজেছেন তার প্রায় প্রতিটা জায়গায় তিনি গেলেন। দণ্ডকারণ্য হোক কি উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি হোক কি বিহার, বসবাস-অযোগ্য প্রত্যেকটি জায়গায় উদ্বাস্তুদের লড়াইয়ের সাক্ষী থেকেছেন তিনি। নিছক গবেষণার টান থেকে কি এহেন পরিশ্রম বা সাধনা সম্ভব? হয়ত, হয়ত নয়, কিন্তু নিছক গবেষণা থেকে মানবসংগ্রামের এক মরমী দলিলে এভাবেই উত্তরণ ঘটেছে  ‘মার্জিনাল মেন’-এর।


চলুন, বিশেষ কিছু অংশ তুলে ধরি বইটি থেকে। পরবর্তী পর্বেও এই বইয়ের কথা আবার হয়তো আসবে।


“দেশবিভাগের আগে থেকেই যখন সুস্পষ্ট বােঝা গিয়েছিল যে পাকিস্তান হতে যাচ্ছে, তখন থেকেই মুসলমানরা অত্যন্ত সচেতনভাবে যেভাবে হিন্দুদের মানসিক নিপীড়ন করতে থাকে, তাই প্রথমদিকে হিন্দুদের মাতৃভূমি ছেড়ে আসতে বাধ্য করে। তাছাড়া, এ সময় থেকেই হিন্দুদের মধ্যে একটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। তাদের ভয় হয়েছিল মুসলমানদের হিন্দুনারী-লুব্ধতা থেকে তাদের পক্ষে ঘরের মেয়েদের বাঁচানাে কঠিন হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থ ‘উদ্বাস্তু’ থেকে একটি ঘটনা তুলে দেওয়া যেতে পারে :


এক হিন্দু মহিলা পুকুরে স্নান করতে নেমেছেন। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু যুবক ও বৃদ্ধ মুসলমান পুকুরের দুপারে জড় হয়ে অশ্লীল ছড়া কাটতে শুরু করল। এপার থেকে আওয়াজ উঠল “পাক পাক পাকিস্তান।” অন্য পার থেকে উত্তর এল, "হিন্দুর ভাতার - মুসলমান।” ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটি জলের মধ্যে অসাড় হয়ে দাড়িয়ে রইল। একজন মধ্যবয়স্ক মুসলমান সিড়ি বেয়ে স্নানের ঘাটে নেমে এসে বলল, "বিবিজান, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে! দেরি করছ কেন? বাড়ি যাবে না?" মেয়েটি তখনাে জলের মধ্যে স্থির, আড়ষ্ট হয়ে দাড়িয়ে। তারপর দুপারে সমবেত মানুষের আনন্দোল্লাসের মধ্যে মধ্যবয়স্ক লােকটি বলল, “আরে, তােদের চাচীর গটগুলাে শক্ত হয়ে গেছে রে। ওর নড়বার শক্তি নেই। তােরা ওকে হাত ধরে জল থেকে তুলে নিয়ে আয়।”


হিন্দুরা কি ভয়ানক মানসিক যন্ত্রণায় পুড়ছিল, এ ঘটনা তারই সাক্ষ্য বহন করে। এরা হিন্দু মধ্যবিত্ত। এরাই পূর্ববঙ্গের সম্ভ্রান্ত, প্রভাবশালী সম্প্রদায়। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে এই হিন্দু সম্প্রদায়ের অবদান অসামান্য। এই শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলােকেরাই স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে হাসিমুখে ফাসিতে প্রাণ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও কর্মীরা প্রায় সকলেই ছিলেন এই শ্রেণীর মানুষ।”


পশ্চিমবঙ্গে বইটি কিনতে পারবেন: এখানে

মন্তব্যসমূহ