আনিস খানের মৃত্যু এবং...

 












আনিস খানের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হচ্ছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক ইস্যুর মতই কদিন বাদেই হয়ত থিতিয়েও যাবে। কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল, আইএসএফ এবং আইমিম... পঞ্চজনাই আনিস খানকে "আমাদের লোক" বলে দাবি করেছেন বিভিন্ন সময়ে। এমনকি বিজেপি পর্যন্ত আনিসের মৃত্যুর প্রতিবাদে পদযাত্রা ডেকেছে (অবশ্য শেষমেশ কর্মীদের ব্যাপক ক্ষোভের মুখে নেতৃত্ব সে পদযাত্রার ইস্যু বদলাতে বাধ্য হয়েছেন)।
আনিস খানের রাজনীতি ঠিক কী ছিল সাধারণ মানুষ জানেন না, রাজ্যের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া অবশ্যই জানাবেও না। তবে আনিসের মৃত্যুর বিচারের দাবিতে বামপন্থী ও অতিবামপন্থীদের মাত্রাতিরিক্ত সোচ্চার দেখে হয়ত অনেকেই অনুমান করে নিতে পেরেছেন।

আনিস খানের রাজনৈতিক দল কী তা জানা না গেলেও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান কী, সেটা তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় করা একাধিক ঘোষণা থেকেই স্পষ্ট। আনিস মনে করতেন, এ দেশে কুড়ি কোটি মুসলমান আছে, সুতরাং উদার ও মুক্তমনা হিন্দুদের উপর নির্ভর করে অধিকার আদায়ের ভাবনা মুসলমানদের ছাড়তে হবে। স্পষ্টতই, তিনি যে কালেক্টিভের হয়ে অধিকার আদায়ের লড়াই লড়তেন সেটি কেবল ও কেবলমাত্র ধর্মভিত্তিক।
আনিস ভারতীয় অঙ্গরাজ্য কাশ্মীরকে ব্রিটিশ উপনিবেশের সঙ্গে তুলনা করতেন (প্রসঙ্গত, উত্তরপূর্ব ভারত নিয়ে তিনি কখনোই এরকম কোনো মন্তব্য করেন নি, কারণ সেখানে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই)। আনিস শিক্ষাক্ষেত্রে ইউনিফর্মের উপরে হিজাবের অধিকারকে জায়গা দিতেন এবং সরকারি স্কুলে সরস্বতীপুজো বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন (অবশ্যই, মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করার নয়)। সর্বোপরি, আনিস সংবিধান হিসেবে কোরান চাইতেন। বুদ্ধিজীবী বামপন্থীরা কেন আনিসকে নিয়ে এতখানি সোচ্চার তা বুঝতে দেরি হয় না।

এখানে একটা কথা বলা জরুরি। আনিস খান স্পষ্টতই মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তার পরেও, তাঁর ঘৃণ্য রাজনীতিকে বিন্দুমাত্র সমর্থন না করেও এবং সেই সম্পর্কে সম্পূর্ণ সতর্ক-সচেতন থেকেও, মৃত্যুর ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত।
কারণ যে রাজ্যের মন্ত্রীসভা-আইনসভায় পর্যন্ত কুখ্যাত মৌলবাদীরা আছেন, যে রাজ্যের রাজধানীর মহানাগরিককে সোশ্যাল মিডিয়ার জামাতি ধর্মান্ধদের সঙ্গে সস্নেহে আলোচনারত দেখা যায় সে রাজ্যে "মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক হওয়ার কারণে" আনিসের মৃত্যু হয়েছে এ কথা বললে ঘোড়ায় হাসবে। এনকাউন্টারের তো প্রশ্নই ওঠে না, এই হাওড়াতেই কয়েকমাস আগে টিকিয়াপাড়ার দাঙ্গাবাজ মহম্মদ সাকিবের লাথি খেয়ে পুলিশ পরদিন সোনামুখ করে তার বাড়িতে চালডাল পৌঁছে দিতে গেছিল।
হাওড়া গ্রামীণের পুলিশ সুপার জানিয়েছেন আনিসের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক অভিযোগ ছিল, যার মধ্যে পকসোর মত নাবালিকার উপর যৌন হেনস্থার গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। যে রাজ্যে মিথ্যা মাদক কেস দিয়েই বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে ভরে দেওয়া বহুদিনের ট্র্যাডিশন সেখানে পকসোর মত কেস নিয়েও গ্রেফতারি এড়াতে কতটা প্রভাবশালী হতে হয় সহজেই বোধগম্য। এহেন ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুর পিছনে তাই আরো ক্ষতিকর, আরো সাম্প্রদায়িক, আরো ভয়াবহ শক্তির জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে একাধিক খুন-ধর্ষণের মত (যার কোনোটি নিয়েই কলকাত্তাইয়া নাগরিক সমাজের বিবেক সেভাবে জেগে ওঠেনি) এই মৃত্যুর যথাযথ বিচারও তাই সময়ের দাবি।

প্রগতিশীল বন্ধুরা প্রায়শই আমার অসুশীল পোস্ট দেখে ক্ষুণ্ণ হন। বিশেষ করে তাঁদের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন। বাদল শেখের নাম শুনেছেন? (গুগল না করে বলবেন।) গত ৭ই নভেম্বর সন্ধেবেলা নভেম্বর বিপ্লব উপলক্ষ্যে বীরভূমের নানুরে নিজের বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়েছিলেন ৬৮ বছরের বাদল শেখ। অভিযোগ, সেই অপরাধে পরদিন তাঁকে গ্রামের কার্যালয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মারে লেসার ইভিলরা
বাদল শেখকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এইরকম কোনো শোরগোল চোখে পড়েছিল? থানা অভিযান, ব্যারিকেড ভাঙাভাঙি? কলকাতায় কোনো চেতনাদীপ্র মিছিল? দলের ডাঙর ডাঙর নেতাদের ফেসবুকে প্রতিবাদী পোস্টের লহর? নবান্ন অভিযান? মিডিয়া সেনসেশন, সর্বাধিক বিকৃত কাগজে একের পর এক প্রতিবেদন? প্রগতিশীল ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রীদের সংগ্রামী কর্মসূচী ইত্যাদি প্রভৃতি? হয়নি! কারণ সেই আন্দোলনে মেনস্ট্রিম মিডিয়ার ফোকাস বা মৌলবাদীদের সাংগঠনিক অংশগ্রহণ, কোনোটাই থাকত না। বাদল শেখ সংবিধান হিসাবে কোরান চাইতেন না, সুতরাং বাদলরা এক্সপেণ্ডেবল।

বামপন্থীরা কেন নভেম্বর বিপ্লবের লাল পতাকা তুলতে গিয়ে নিহত সংখ্যালঘু কৃষকের খুনের ঘটনায় সামান্যতম আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে না, অথচ মৌলবাদী রাজনীতির সমর্থক সংখ্যালঘু ছাত্রর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় সর্বশক্তি নিয়ে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে গেলেই বুঝবেন এদের কেন আজ এই দশা। হ্যাঁ, উত্তরটা হয়ত খুব একটা পছন্দ হবে না। অপ্রিয় সত্য চিরকালই তিক্ত।

সোহম পাল


মন্তব্যসমূহ