বিল্পব ও গান্ধী #১

 

অবিভক্ত বাঙ্গালার ফরিদপুর জেলার লোনসিং গ্রাম। নিজের সময়ে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অস্ত্রবিশারদ, লাঠিসেনাপতি পুলিনবিহারী দাশ এই গ্রামেরই কীর্তিমান সন্তান। কতবার যে তাঁর অনুশীলন সমিতির সভ্যরা পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের হাত থেকে হিন্দুর প্রাণ-মান রক্ষা করেছে তা গুণে শেষ করা যাবেনা। শুধু লাঠিখেলাতেই নয়, ছোরাখেলা, যুযুৎসু ইত্যাদি লড়াইতেও সমান পারদর্শী পুলিনবাবু ছিলেন ব্রিটিশের চোখে মূর্তিমান আতঙ্ক। সুযোগ্য নেতৃত্বগুণে পূর্ববাংলার প্রান্তে প্রান্তে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ৫০০র অধিক অনুশীলন শাখাকেন্দ্র। 


 

মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী। যাকে কেউ কেউ মহাত্মা গান্ধীও বলে থাকেন, তবে সেটা তত জরুরি ব্যাপার না, আবেগের আতিশয্যে কেউ কেউ মিঠুন চক্রবর্তীকেও মহাগুরু বলতো। কংগ্রেসে গান্ধীর একাধিপত্য কে চ্যালেঞ্জ করার মত কেউ না থাকলেও, বাঙ্গালার বিপ্লবীরা প্রশ্নের মুখের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন, তথাকথিত মহাত্মার তথাকথিত মহত্বকে।


সাল:-১৯১৯


"এই সময়ে চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়ীতে প্রত্যহই অপরাহ্নে বালক, যুবক, প্রৌঢ় নির্বিশেষে সকলে সমবেত হইত। সি. আর. দাসের নেতৃত্বে তখন বঙ্গদেশ গান্ধীর অহিংস অসহযােগ মন্ত্র পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করিয়াছে।


ইতিমধ্যে গান্ধী আমার সম্বন্ধে ও আমার অনুশীলন সমিতি সম্বন্ধে বহু বিষয়েই শুনিয়াছিলেন এবং আমি যে অহিংস অসহযােগ সমর্থন করি না তাহাও জানিতে পারিয়া আমার সহিত কথা বলিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। ব্যারিষ্টার সুবােধ রায় (ডাঃ বিধান রায়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) এবং স্বর্গীয় আনন্দমােহন বসুর পুত্র ব্যারিষ্টার হিমাংশু বসু আমাকে সঙ্গে করিয়া সি, আর, দাসের বাড়ীতে যাইয়া গান্ধীর সহিত পরিচয় করাইয়া দিলেন। কিছুক্ষণ আলােচনার পর গান্ধী জানাইলেন যে, তিনি রুদ্ধদ্বার কক্ষে আমার সহিত আলােচনা করিবেন, এবং হয় তিনি আমাকে তাহার মত গ্রহণ করাইবেন, নতুবা তিনিই আমার মতে দীক্ষিত হইবেন। 


সেই সময় মতিলাল নেহেরুও তথায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি হাসিয়া বলিলেন যে, তুমি যখন সি.আর. দাসকেই তােমার স্বমতে আনিতে পারিয়াছ, তখন পুলিন দাসকে তো অতি সহজেই স্বমতে আনিয়া ফেলিবে। 


তখন গান্ধী কিন্তু বলিয়া ফেলিলেন, নাহে না, এই ক্ষেত্রে একটু শক্ত পাল্লায়ই পড়িয়াছি।


আমাদের গুপ্ত আলােচনা তিন দিন চলিয়াছিল, ব্যারিষ্টার সুবােধ রায় এবং ব্যারিষ্টার হিমাংশু বসু আলােচনাকালে সর্বদাই উপস্থিত ছিলেন।


আলােচনা দীর্ঘ হইলেও, এইখানে শুধু সারমর্ম টুকুই বলিতেছি।


গান্ধী:- বৃটিশ গভর্ণমেন্ট বিভিন্ন সময়ে যে সমস্ত অত্যাচার, দুর্ব্যবহারাদি করে এবং যে-ভাবে দেশের অসংখ্য লােককে নিঃসহায়, নিরক্ষর ও দরিদ্র করিয়া রাখিয়াছে তাহা কি তুমি সমর্থন করিতে পার?


আমি:—ঐ সমস্ত সমর্থন করি না বলিয়াই ত ইংরাজ তাড়াইয়া স্বাধীনতা লাভের জন্য চেষ্টা করিতেছি। আমরা স্বাধীন হইতে পারিলে আমাদের দেশের সর্বরূপ দুঃখ,দৈন্য নিরক্ষরতা আমরা দূর করিতে পারিতাম।


গান্ধী:—কিন্তু তােমরা স্বাধীন হইতে পারিলে কই? তােমরা বৈপ্লবিক পন্থা অবলম্বন করিয়াছিলে, তাহা ত ব্যর্থ হইল, এইবারে অহিংস অসহযােগ নীতি গ্রহণ কর তােমরা নিশ্চয়ই স্বাধীনতা লাভ করিবে।


আমি:-অহিংস অসহযােগ নীতি গ্রহণ করিলেই যে স্বাধীনতা পাইব, তাহারই বা কি যুক্তি আছে। অধিকন্তু আমাদের বৈপ্লবিক পন্থা ব্যর্থ হইয়াছে একথাও আমি স্বীকার করিতে পারি না। আমাদের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার প্রভাবে বৃটিশ গভর্ণমেন্ট বিশেষভাবেই বিচলিত হইয়াছিল—তাহার ফলেই বঙ্গ-ভঙ্গ রদ হইয়াছে, তাহার ফলেই মন্টেগু সংস্কার আসিয়াছে এবং ভারতীয়গণের হন্তে আরও অধিক অধিকার অর্পণের প্রতিশ্রুতিও বৃটিশ গভর্ণমেন্ট দিতেছে।


গান্ধী:-কিন্তু স্বাধীনতা তো পাও নাই! সুতরাং তােমাদের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে।


আমি:—ব্যর্থ হইয়াছে, একথা আমি স্বীকার করিতে পারি না। আমাদের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা আরম্ভ হইয়াছে মাত্র, সুকৌশলে পরিচালনা করিতে পারিলে এবং প্রচেষ্টা পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হইলে তবে ত স্বাধীনতা আসিবে। স্বাধীনতা লাভ ত অত সহজ ব্যাপার নয় যে, বিপ্লব শুরু মাত্রই পূর্ণ ফল মিলিয়া যাইবে। স্বাধীনতা লাভের জন্য বহু সময়, বহু স্বার্থত্যাগ, বহু শ্ৰম, অধ্যবসায় ও আত্মাহুতির প্রয়ােজন। বহু ব্যর্থতার পরে শিবাজী স্বাধীন রাজ্য স্থাপনে সমর্থ হইয়াছিলেন। শতাধিক বৎসরেরও অধিককালের প্রচেষ্টার পর দাক্ষিণাত্যে বিজয়গড়ের স্বাধীন হিন্দু রাজ্য স্থাপিত হইয়াছিল। পাঁচশত বৎসরের প্রচেষ্টার পর চীন, হুণ, শক প্রভৃতির উপদ্রব হইতে ভারত রক্ষা পাইয়াছিল। ইতালী প্রভৃতি পরাধীন দেশও প্রায় শতাধিক বৎসরের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার পর তবে অষ্ট্রিয়ার অধীনতা-পাশ হইতে মুক্ত হইতে পারিয়াছিল। পৃথিবীতে কোন পরাধীন দেশই অতি অল্প সময়ে স্বাধীন হইতে পারে নাই। কিন্তু আমাদের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার ফলে অপেক্ষাকৃত অল্প সময়েই আমরা অনেক সুফল ইতিমধ্যেই পাইয়াছি।


গান্ধী:—কিন্তু বিপ্লব পরিচালনার জন্য যে পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্র শথের প্রয়ােজন হই তাহা সংগ্রহ করা তােমাদের পক্ষে অসম্ভব ও অসাধ্য।


আমি:—ঐকান্তিকতা ও তীব্র আকাঙ্খা থাকিলে জগতে কিছুই অসম্ভব কি অসাধ্য হয় না।


গান্ধী:—কিন্তু বিপ্লব করিতে গেলেই যুদ্ধ বাধিবে, তাহাতে অসংখ্য দরিদ্র লােকের প্রাণ যাইবে, কত শত নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটিবে, তাহা কি করিয়া সমর্থন করিতে পার?


আমি:—পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকিয়াও ত আমরা কত শত নিষ্ঠুর ঘটনা প্রত্যক্ষ করিতেছি কত লােক অনাহারে, অর্ধাহারে প্রাণ হারাইতেছে, দরিদ্রের সংখ্যা ক্রমেই বাড়িতেছে—ঐ সমস্ত হেয় নিষ্ঠুর ঘটনা ও প্রাণহানির প্রতিকার কামনা করিয়াই ত আমরা স্বাধীনতা লাভ হেতু বিপ্লব আরম্ভ করিয়াছিলাম। অবশ্য পরিণামে যুদ্ধাদি ব্যতীত স্বাধীনতা লাভ হয় না, ইহাও আমরা বিশ্বাস করি এবং পৃথিবীতে কোন কালে কোনও পরাধীন দেশই বিপ্লব ও যুদ্ধ-বিগ্রহাদি ব্যতীত স্বাধীন হইতে পারে নাই।


গান্ধী:—পূর্বে হয় নাই বলিয়া এখন কেন হইবে না? আমি ত তােমাকে যেরূপ পরিষ্কার দেখিতে পাইতেছি, সেইরূপই স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি যে, দেশের সমস্ত লােক যদি অহিংস অসহযােগ আন্দোলন সমর্থন করে, তবে তাহা দ্বারা ভারতবর্ষ অবশ্যই স্বাধীনতা লাভ করিবে।


আমি জানাইলাম যে, তাহার এই আশ্বাস বাণীতে আশ্বস্ত হইতে

পারিলাম না।


গান্ধী:—আমরা যদি সম্পূর্ণরূপে অহিংস থাকিয়া সর্বরূপ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকি, তবে আমাদের সহ-শক্তি এবং ত্যাগের প্রভাবে মুগ্ধ হইয়া অত্যাচারিগণ নিজ হইতেই স্বাধীনতা প্রদান করিতে বাধ্য হইবে, তাহাদের কঠোর প্রাণও দ্রবীভূত হইয়া যাইবে।


আমি:-সাধারণতঃ কিন্তু দেখিতে পাই, প্রবল অত্যাচারিগণ নিরীহ, নির্জীবগণকে নির্বিবাদে ও নিঃশঙ্কচিত্তে অতি উল্লাসের সহিতই অত্যাচার করিতে থাকে এবং ধ্বংসও করিয়া ফেলে; কদাচ ক্ষান্ত হয় না। বিশেষ কোন বিপর্যয়ের কারণ না ঘটিলে কখনও অত্যাচারি গণের অত্যাচারপ্রবণ নিষ্ঠুর এর প্রাণ তিলমাত্রও কোমল হয় না।"


তথ্যসূত্র:-

১. আত্মকথা,পুলিন বিহারী দাস

২.অনুশীলন সমিতির ইতিহাস,জীবনতারা হালদার




মন্তব্যসমূহ